বৈচিত্রময় প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আমাদের এই বাংলাদেশ। এই সম্পদের উপর ভর করেই গড়ে উঠেছে আমাদের সমৃদ্ধশালী কৃষি। প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে , কৃষির সার্বিক উন্নয়নের জন্য  মাটির ধরন , ভূমি রূপ এবং জলবায়ুগত উপাদানের উপর ভিত্তি করে সারা দেশকে মোট ৩০ টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো "মধুপুর অঞ্চল "। মধুপুর অঞ্চল টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর ঘাটাইল সখিপুর মির্জাপুর, ময়মনসিংহ জেলার ফুল বাড়িয়া, ভালুকা, গাজীপুর জেলার গাজীপুর সদর, শ্রীপুর কালিয়াকৈর ,কাপাসিয়া ঢাকা জেলার সাভার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও নরসিংদীর বেলাব উপজেলার বিশেষ অংশ নিয়ে গঠিত ।এর মোট আয়তন প্রায় ৪২৪৪ বর্গকিলোমিটার ।
  এ বৃহৎ কৃষি পরিবেশ অঞ্চলটির উত্তর থেকে দক্ষিনের  জলবায়ুর বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত  হয় ।শীতকালে উত্তরাংশে ক্রমশ ঠান্ডা পরিলক্ষিত হয় গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্যে থাকে মাঝে মাঝে প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠানামা করে । শীতকালে ১৬ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্য থাকে,  মাঝে মাঝে অনেক সময় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে  নেমে আসে।
 বৃহৎ এই কৃষি পরিবেশ অঞ্চলটির উত্তরে মধুপুর গড় গাজীপুর অংশে ভাওয়াল গড় অবস্থিত। মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের বিভিন্ন উদ্ভিদ,অগনিত জীব অনুজীব, কীটপতঙ্গ ও পশুপাখি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভাবে কৃষির উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিতেছে।
  অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে এই অঞ্চলের দক্ষিণ অংশের কৃষি ভূমি আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে এখন আর অবশিষ্ট নাই বললেই চলে আর যতটুকু আছে শিল্প কারখানার অপরিকল্পিত গ্যাস ও বর্জ্য নিষ্কাশনের ফলে সেখানে নিরাপদ কৃষি কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে
মধুপুর কৃষি অঞ্চলের উত্তর  ও মধ্যাঞ্চল বিশেষ করে মধুপুর, ঘাটাইল ,সখিপুর ,মির্জাপুর ,ফুলবাড়ীয়া, ভালুকা ,শ্রীপুর ,কাপাসিয়া ও কালিয়াকৈর এর কিছু অংশে এখনো সারা বছর বিভিন্ন ধরনের ফসল ফলিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিতেছে।
 চালা এবং বাইদের সমন্বয়ে গঠিত এই অঞ্চলের মাটিতে প্রকৃতির সহযোগিতায় অতি সহজে কম খরচে নিরাপদ ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফসল। বাইদ জমিতে আউশ আমন বোরো মৌসুমে বিভিন্ন প্রজাতির ধান চাষ করা হয়,। কিছু কিছু জমিতে রবি মৌসুমে তৈল জাতীয় ফসল উৎপাদন করা হয়।
 আবার কিছু নিচু জমিতে পরিকল্পিত ভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের মাছের চাষ করে অত্র অঞ্চলের মাছের চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত অংশ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিতেছে।                           
   
  অত্র অঞ্চলের সমতল চালা জমিতে আনারস,কাঁঠাল,  পেঁপে পেয়ারা কলা ও লেবু সহ বিভিন্ন ধরনের সবজি, মসলা ও ভেষজ উদ্ভিদ সহ প্রায় ,৮৩ প্রকারের ফসল বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদিত হয়। মধুপুর অঞ্চলের উৎপাদিত আনারস,কাঁঠাল পেঁপে পেয়ারা কলা ও লেবু সারা দেশের চাহিদা মিটিয়ে স্বল্প পরিসরে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে।
 সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাত করণের অভাবে আনারস পেঁপে পেয়ারা কলা ও লেবু সহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির উল্লেখযোগ্য অংশ প্রায়ই নষ্ট হয়ে যায়,যার ফলে কৃষকরা অধিকাংশ সময় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
 অত্র অঞ্চলের কৃষির সার্বিক উন্নয়নের জন্য আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি। বিশেষ করে আনারস পেঁপে  পেয়ারা কলা ও লেবু প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার তৈরি করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিপণনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে মধুপুর অঞ্চলের কৃষির বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে।
 হানিকুইন,জায়ান্ট কিউ ও এম ডি 2 জাতের আনারস সারা পৃথিবীতে রসালো ফল হিসাবে খুবই পরিচিত।এই সমস্ত আনারস মধুপুরের মাটিতে স্বল্প খরচে নিরাপদ ভাবে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয় এবং গুণগত মান অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। মধুপুরের আনারস প্রক্রিয়াজাত করণ নিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা করা হলেও টেকসই পরিকল্পনার অভাবে কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে এখনো পর্যন্ত সক্ষম হয়নি  আনারস এমন একটি মূল্যবান সম্পদ যার কোন অংশই ফেলনা নয়। যুগ যুগ ধরে আনারসের পাতা গবাদি পশুর উৎকৃষ্ট পুষ্টিকর খাবার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, ইদানিং আবার আনারসের পাতা দিয়ে মূল্যবান সুতা তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে,। আনারসের জ্যাম জেলি ও আচার খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার।  আনারসের ছোবড়া দিয়ে মূল্যবান ভিনেগার ও ডিটারজেন্ট তৈরি করে বিভিন্ন দেশে বাজার জাত করা সম্ভব।
           ইদানিং কফি, কাজুবাদাম রাম্বুটান ও এভোকাডো সহ বিভিন্ন ধরনের উচ্চ মূল্যের বিদেশি ফল চাষের জন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে পরিক্ষা মুলক চাষাবাদ করা হচ্ছে,। সবচেয়ে মজার ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, প্রায় অর্ধশত বছর আগে থেকেই বিভিন্ন মিশনারির মাধ্যমে মধুপুর অঞ্চলে পারিবারিক ভাবে এই সমস্ত উচ্চ মূল্যের বিদেশি ফল সফল ভাবে চাষ করা হচ্ছে।
        
            
            মধুপুর কৃষি অঞ্চলের মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু পৃথিবীর যেকোন অঞ্চলের যে কোন ফসল উৎপাদনের জন্য উপযোগী, প্রয়োজন শুধু সঠিক নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। বিভিন্ন ধরনের ফসলের উৎপাদন ও নিবিড় পরিচর্যার জন্য সমস্ত অঞ্চল কে পুনরায় গ্রাম ভিত্তিক বিভক্ত করে কৃষকের মতামতের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট ফসল উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট কৃষক নির্ধারণ করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা। সার ও কীটনাশকের ব্যবহার সম্পর্কে কৃষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।              
আনারস কাঁঠাল পেঁপে পেয়ারা কলা ও লেবু প্রক্রিয়াজাত ও বিপণন করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।      
  তরুণ ও যুবকদের অংশগ্রহনের মাধ্যমে বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করে,সমস্ত মধুপুর অঞ্চল কে কৃষি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা।
               
               সার্বিক ভাবে কৃষির উন্নয়নের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন তরুণ ও যুবকদের মাঝে কৃষি কে জনপ্রিয় ও লাভজনক পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা,, তাদেরকে উৎপাদনের কাজে সম্পৃক্ত করে কৃষি ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত করণ ও বিপণনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ।      
                   তরুণ ও যুবকদের মাঝে কৃষি কাজ কে জনপ্রিয় ও লাভজনক করার জন্য মধুপুরের মহিষমারা কলেজের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে """উৎপাদন মুখী শিক্ষা"",যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, বিভিন্ন ফসল উৎপাদন বিপণন ও প্রক্রিয়াজাত করণ।
          
                  মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন এ আইপি, জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রাপ্ত কৃষক, সাবেক ইংরেজী শিক্ষক, প্রতিষ্ঠাতা মহিষমারা কলেজ ও উদ্ভাবক ""উৎপাদনমুখী শিক্ষা "