বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে খাদ্য নিরাপত্তা এবং পুষ্টি নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে শুধু ধান, গম বা আলুর ওপর নির্ভরশীল থাকলে ভবিষ্যতে তা টেকসই হবে না। এ প্রেক্ষাপটে বিকল্প খাদ্যশস্য হিসেবে কাসাবা (Cassava) একটি সম্ভাবনাময় ফসহিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।
কাসাবা মূলত এক ধরনের কন্দজাতীয় ফসল যা বিশ্বের অনেক দেশে প্রধান কার্বোহাইড্রেট উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার কিছু দেশে এটি চাল কিংবা আলুর বিকল্প হিসেবে খাওয়া হয়। এই ফসলটি খরাপ্রবণ ও অনুর্বর জমিতেও সহজে উৎপাদিত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় সহায়ক হতে পারে।
কাসাবার বৈজ্ঞানিক নাম - ম্যানি-হট এস-কিউ-লেন-টা (Manihot esculenta )এটি একটি কন্দ জাতীয় ফসল যা শিমুল আলু নামেও পরিচিত। কাসাভাকে ব্রাজিলীয় অ্যারারুট, মানিয়ক বা ট্যাপিওকা নামেও ডাকা হয়।
কাসাবা সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে:
মিষ্টি কাসাবা (Sweet Cassava): এতে হাইড্রোজেন সায়ানাইড (HCN) বা সায়ানোজেনিক গ্লাইকোসাইডের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। সাধারণ রান্না বা সিদ্ধের মাধ্যমে এটি নিরাপদ খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য।সাধারণত এটি মানুষ খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
তেতো কাসাবা (Bitter Cassava):
এতে উচ্চ মাত্রার সায়ানোজেনিক যৌগ থাকে, যা সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত না করলে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে।এই প্রজাতিটি মূলত শিল্প বা পশুখাদ্যের জন্য ব্যবহৃত হয়।খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের আগে এটি দীর্ঘসময় পানিতে ভিজিয়ে রাখা ও সিদ্ধ করার প্রয়োজন পড়ে।
বাংলাদেশে এখনো কাসাবার চাষ সীমিত পর্যায়ে হলেও গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকায় সফলভাবে চাষ করা সম্ভব। এটি শুধু খাদ্য ফসল নয়, এর নানা রকম শিল্পজাত ব্যবহারও রয়েছে। যেমন—কাসাবা থেকে উৎপাদিত স্টার্চ টেক্সটাইল, কাগজ, বেকারি ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে ব্যবহারযোগ্য। ফলে এটি দেশের শিল্প খাতের কাঁচামাল হিসেবে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও সৃষ্টি করতে পারে।
কাসাবা চাষের মাধ্যমে কৃষকরা নতুন আয়ের উৎস পেতে পারেন এবং গ্রামীণ অর্থনীতি হতে পারে আরও শক্তিশালী। পাশাপাশি খাদ্য বৈচিত্র্য ও পুষ্টি নিশ্চিতেও এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে শর্করা, আঁশ এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান থাকে।
খাদ্য চাহিদা, কৃষি নীতি ও জলবায়ু অভিযোজনে কাসাবার সম্ভাবনা:
বাংলাদেশে কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা আজ সময়ের দাবি। প্রচলিত খাদ্যশস্য যেমন ধান, গম ও আলুর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা খাদ্যব্যবস্থাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। বর্তমান বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা পূরণে বিকল্প ও টেকসই ফসল উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যাচ্ছে আরও তীব্রভাবে। এই প্রেক্ষাপটে কাসাবা (Cassava) হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প।
কৃষি নীতিতে কাসাবার অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা:
বর্তমানে জাতীয় কৃষিনীতি প্রধানত ধান ও প্রধান শস্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। অথচ, কাসাবা এমন একটি ফসল যা খরাপ্রবণ, লবণাক্ত বা অনুর্বর জমিতেও ভালো ফলন দিতে পারে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চল, চরাঞ্চল কিংবা পাহাড়ি এলাকায় পতিত জমি ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়। কৃষিনীতির আওতায় কাসাবা চাষে প্রণোদনা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা জোরদার করলে কৃষকের আয় বাড়বে এবং খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বিকল্প নিশ্চিত হবে।
রপ্তানিতে কাসাবার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অন্যতম।বিশ্ববাজারে কাসাবা থেকে তৈরি হওয়া স্টার্চ, স্ন্যাকস, বেকারি পণ্য, পশুখাদ্য এবং শিল্প কাঁচামালের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতিবছর এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলারের কাসাবা পণ্য রপ্তানি হয়। বাংলাদেশও চাইলে কাসাবা প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলে রপ্তানিমুখী এই বাজারে অংশ নিতে পারে। এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় যেমন বাড়বে, তেমনি কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরা, অতিবৃষ্টি ও লবণাক্ততার মতো সমস্যায় ধান ও অন্যান্য প্রচলিত ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কাসাবা একটি সহনশীল ফসল; অল্প পানি ও কম যত্নেও এটি ভালো ফলন দেয়। ফলে জলবায়ু অভিযোজনে এটি একটি কার্যকরী ফসল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। টেকসই কৃষির অংশ হিসেবে কাসাবাকে অন্তর্ভুক্ত করলে দেশের খাদ্য ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব।
বাংলাদেশে সম্ভাব্য অক্ষতিকর প্রভাব:
বাংলাদেশে কাসাবা চাষ এখনও পরীক্ষামূলক ও সীমিত পর্যায়ে হলেও এর ব্যাপক চাষাবাদের আগে কিছু অক্ষতিকর সম্ভাবনার বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।
সায়ানাইড বিষক্রিয়ার ঝুঁকি থাকায় প্রক্রিয়াজাত না করে কাঁচা বা অল্প সিদ্ধ কাসাবা খেলে তাতে থাকা সায়ানোজেনিক গ্লাইকোসাইড হাইড্রোজেন সায়ানাইডে রূপান্তরিত হয়ে মানবদেহে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে।এর ফলে বমি, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে।
কাসাবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জ্ঞান সীমিত হওয়ায় তেতো জাতের কাসাবা ভুল করে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়তে পারে সঠিক চাষাবাদ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি না জানা থাকলে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।কাসাবার বাজারমূল্য ও চাহিদা দেখে যদি কৃষকরা এককভাবে কাসাবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।পুষ্টিগত দিক থেকেও এটি একমাত্র খাদ্য হিসেবে গ্রহণ উপযুক্ত নয়, কারণ এতে প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজের পরিমাণ কম।যদিও এটি খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল, তবে অপ্রয়োজনীয় রাসায়নিক ব্যবহার বা সেচের জন্য অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করলে পরিবেশগত ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
সমাধান ও করণীয়:
কাসাবা চাষ ও ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মিষ্টি ও কম বিষাক্ত জাতের কাসাবা উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে।খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের আগে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নীতির অংশ হিসেবে কাসাবার স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত।
কিছুটা নেতিবাচক দিক থাকলেও
কাসাবা নিঃসন্দেহে একটি সম্ভাবনাময় ফসল, তবে এর যথাযথ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন জ্ঞান, সচেতনতা ও নীতিগত দিকনির্দেশনা। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে এটি যেমন দেশের কৃষি ও অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে, তেমনি অসাবধানতার কারণে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতেও পারে।
বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি এবং জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে কাসাবার রয়েছে সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা। কৃষি পরিসংখ্যান ২০২১” (Agricultural Statistics 2021) অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট অনাবাদি জমির পরিমাণ ৪ লক্ষ হেক্টর যার অধিকাংশই কাসাবা চাষের উপযোগী। সেজন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত কৌশল যেখানে কাসাবাকে জাতীয় কৃষিনীতির অংশ করা হবে, গবেষণায় গুরুত্ব বাড়ানো হবে এবং প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানিমুখী উদ্যোগে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে কাসাবা হতে পারে বাংলাদেশের পরবর্তী সম্ভাবনাময় কৃষিপণ্য।
অন্ধভাবে বা বিশৃঙ্খলভাবে নয়, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিবেচনায় পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে কাসাবা হতে পারে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক একটি ফসল।