ঢাকা | 05 November 2025

লৌহজঙ নদী পরিণত হয়েছে খালে

স্টাফ রিপোর্টার, .
নিউজ প্রকাশের তারিখ :Nov 5, 2025 ইং
ছবির ক্যাপশন: ছবির ক্যাপশন:
ad728
আজ থেকে প্রায় ৬৫ বছর আগের কথা। টাঙ্গাইল শহরের বুক চিরে বয়ে চলা খরস্রোতা নদী লৌহজঙ-এর ঢেউ ভেঙ্গে চলতো লঞ্চ। মাঝিরা নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতো মাছের সন্ধানে। টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়ে উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেত বাণিজ্য করতে। রাজশাহী থেকে আমের নৌকা এসে ভিড়তো শহরের কোল ঘেঁষে। সেই থেকে শহরের কলেজ পাড়া এলাকার একটি রাস্তার নাম হয় ‘আমঘাট রোড’। 
বর্তমানে এসব কেবলই ইতিহাস। টাঙ্গাইল শহরের কোথাও খুঁজে সেদিনের বাস্তবতা পাওয়া যাবে না। তবে আমঘাট রোড আজও রয়েছে। তার পাশেই লৌহজঙ দখল হতে হতে সরু খালে পরিণত হয়েছে। ষাটের দশকের অন্যতম কবি ও মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল খান মাহবুব আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের চোখের সামনে লৌহজঙকে হত্যা করা হলো। অথচ কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। সচেতনতাবোধ কী সবাই হারাতে বসেছি।
অনেকটা প্রকাশ্যে এবং অবাধে দখল প্রক্রিয়া চললেও নদীটি রক্ষার ব্যাপারে শক্তিশালী কোন উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের। তবে মাঝে মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযান পারিচালনা করা হলেও তা স্থায়ী হয়নি। নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে বসতি তৈরি হয়েছে বাড়ি-ঘর। ক্রমেই বাড়ি ঘরের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। 
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টাঙ্গাইল শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া লৌহজঙ নদীর দু’পাড়ের মানুষ নিজেদের ইচ্ছামত দু’দিক থেকে মাটি ভরাট করে দখল করে নিয়েছেন। কোন কোন জায়গায় আবাদ করা হচ্ছে। শহরের কাগমারা, ধুলেরচর, স্টেডিয়াম এলাকা, পশ্চিম আকুর টাকুর, বেড়াডোমা, কাগমারীসহ বিভিন্ন এলাকায় নদী দখল করে বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। অনেক জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে বিল্ডিং। কেউ গড়ে তুলেছেন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। দু’দিক থেকে দখলের ফলে লৌহজং নদী পরিণত হয়েছে খালে।  
দেশের সর্ব বৃহৎ প্রশস্থ নদী যমুনার শাখা নদী হিসেবে লৌহজঙের জন্ম। টাঙ্গাইল শহরের বুক চিরে করটিয়া হয়ে ঢাকার দিকে চলে গেছে এটি। শুরুতে খরস্রোতা নদী হিসেবে লৌহজঙের পরিচিতি ছিল। নদী পাড়ে ছিল অসংখ্য বকুল গাছ। ভোরে লৌহজঙের ঢেউ-এ সোনালী রোদের খেলা আর পাড়ে মাটিতে লুটিয়ে পরা অসংখ্য বকুল ফুল মুগ্ধ করে তুলতো টাঙ্গাইল শহরবাসীকে। কবিদের মনকে জাগিয়ে তুলতো লৌহজঙ। ষাটের দশকের অন্যতম কবি বুলবুল খান মাহবুব লিখেন ‘লৌহজঙের পাড়ে বকুলের গন্ধ মেখে তুমুল প্রেম খুঁজেছে যখন তখন কেন এলে না .। সেইদিনের কথা বলতে গিয়ে বুলবুল খান মাহবুব বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় দেখেছি লৌহজং-এর ছুটে চলা। নদীর পাড়ে শহরের অংশে অজস্র বকুল গাছ ছিল। আমরা বন্ধুরা মিলে বিকেল বেলা সেখানে আড্ডা দিতাম তীরে বকুলের গন্ধ, সামনে লৌহজঙ এর রূপালী ঢেউ সে এক অপূর্ব দৃশ্য। এখন এ সবই কল্পনা। খুব দুঃখ লাগে খরস্রোতা এ নদীকে আমরা মেরে ফেলছি।’
টাঙ্গাইল শহরের মেইন রোড এলাকার বাসিন্দা গীতিকার মাসুম ফেরদৌস বলেন, ছোটবেলায় দেখেছি, নারায়গঞ্জ থেকে এই নদী দিয়ে বড় বড় স্টিমার, লঞ্চ ও হাজারমনি মহাজনি নৌকা চলে যেতো সিরাজগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। বিস্তৃত সেই নদী দখলদারদের কবলে পড়ে এখন সংকীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। দখলদারদের কেউ কেউ বৈধ কাগজপত্রের দাবিও করে থাকেন। নদীপাড়ের জায়গা কিভাবে বৈধ হয়ে গেলো?
জানা যায়, ১৯৯২ সালে ফ্লাড অ্যাকশন প্যান (ফ্যাপ)-২০ প্রকল্পের আওতায় লৌহজং এর উৎসমুখের কাছে (টাঙ্গাইল সদর উপজেলার যুগনী) পানি উন্নয়ন বোর্ড সুইসগেট নির্মাণ করায় নদীতে নৌ চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে পানির প্রবাহও হ্রাস পায়। তার আগে থেকেই লৌহজং নদীর দু’পাড়ে দখল প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এসে দখলের ধুম পড়ে যায়। একই সাথে নদীর পাড়ের বাসা-বাড়ির ল্যাট্রিনের পাইপ সংযোগ করে দেয়া হয় লৌহজঙ নদীতে। এতে মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।
শুধু নদীর পাড়েই দখল প্রক্রিয়া চলেনি। মানচিত্রেও (ম্যাপ/নকশা) দখল হয়েছে লৌহজঙের দু পাড়। টাঙ্গাইল পৌরসভার সার্ভেয়ার আমিনুল ইসলাম জানান, টাঙ্গাইল সদরের সিএস (বৃটিশ আমলের ম্যাপ) রেকর্ডে লৌহজঙ নদী যেভাবে দেখানো হয়েছে, আর এস (পাকিস্তান আমলের ম্যাপ) রেকর্ডে সে নদীর দুপাশে প্লট হয়ে মূল নদী সরু হয়ে গেছে। বর্তমানের অবস্থা আরো খারাপ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির  (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারি গৌতম চন্দ্র চন্দ জানান, বৃটিশ আমলে করা সিএস রেকর্ডে লৌহজং নদীর প্রশস্থতা ১৫০ ফুট দেখা যায়। কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থা এখন আর নেই। দুইপাড়েই দখল হয়েছে। নদীর তলদেশ থেকে পাড় পর্যন্ত পরিমাপপূর্বক নির্ধারণ করা জরুরি। 
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. রাখিল রায়হান বলেন, লৌহজঙ নদীর উৎসমুখ থেকে আরম্ভ করে জেলার মির্জাপুর পর্যন্ত প্রকল্পের মাধ্যমে খনন কাজ করা হবে। যমুনা নদী থেকে পানি আনার ব্যবস্থা করা হবে এবং সারা বছরই লৌহজঙ নদীতে পানির প্রবাহ রাখা হবে যাতে নদীটি জীবিত থাকে। এছাড়া টাঙ্গাইল শহরের হাউজিং থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার নদীর পাড় বাঁধাই করা হবে। প্রকল্পটি ইতিমধ্যে প্ল্যানিং কমিশন থেকে ছাড় হয়েছে। সরকারি অনুমোদন পেলেই কাজ করার প্রক্রিয়া শুরু হবে।



কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ