মাত্র ১৮ টাকা বেতনে চাকরি নিছিলাম। হেসুম আটার জাই, ছাতু আর একবেলা ভাত খাইছি। শেষ বয়সে ১৬ হাজার তুরি বেতন পাইছি। রিটায়ারে আইয়া আবার ছাতু জাই খাওয়ার অবস্থা। আট বছর অইলো অবসরের ভাতা এক টেকাও পাইনাই। অহন খাওয়া চিকিৎসা বেগর মরণদসা। ৪৪ বছর স্কুলে চাকরি করছি। ঠেকায় পইরা সাহায্য চাইয়া আবেদন করছিলাম। এক বছর অইয়া যায় স্কুল ফিরাও চাইলোনা। কথা গুলো বলছিলেন টাঙ্গাইলের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মধুপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি গোলাপ হোসেন। তিনি ১৯৭৪ সালের ৩০ জুন যোগদান করে ২০১৮ সালের ৩০ জুন অবসরে যান। তখনই অবসর ভাতার জন্য আবেদন করেছেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অবসরভাতার টাকা পাননি তিনি।
ধনবাড়ীর নল্লা বাজার এলাকার মমতাজ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বাবুল। তিনি অবসরে গেছেন ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে। তিনিও অবসরভাতার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। তিনি বলেন, আমার অহন ভাত খাওয়ার চেয়ে ওষুধের কথা বেশি ভাবন নাগে। আমি হার্টের রোগি। আমার গিন্নির তিনবার অপারেশন করছি। ডাক্তারের পরামর্শেই চলন নাগে। মাসে সাড়ে ৫ থিকা ৬ হাজার টাকা লাগে। এই টেহার জন্যও অনেক সময় অস্থির থাকন নাগে। অবসরভাতাটা পাইলে কয়টাদিন অন্তত টেনশন ছাড়া কাটাবার পারতাম।
টাঙ্গাইল জেলা অধ্যক্ষ পরিষদের অধ্যক্ষ বজলুর রশীদ খান চুন্নু। তিনিও আড়াই বছর ধরে অপেক্ষায় আছেন কল্যাণ ফান্ড ও অবসরকালীন ভাতার জন্য। তাঁদের মতো টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার শত শত শিক্ষক-কর্মচারীর পাশাপাশি সারাদেশের ৬৪ হাজার শিক্ষক-কর্মচারিরা অন্ধকার জীবনে হাতরিয়ে বেরাচ্ছেন। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। চিকিৎসার জন্য অন্যের দ্বারস্থ হচ্ছেন। ওই শিক্ষক কর্মচারিরা জীবন যৌবনের সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের কোন খোঁজখবর রাখেননা। স্কুল, কলেজ, মাদরাসার শিক্ষক সংগঠনগুলোর নেতারাও তাদের খবর রাখেন না। কে কতটা কষ্টে আছেন সে খবরও রাখেন না কেউ। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ জানেনা জেলায় কতজন স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষক অবসরে গেছেন বা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছেন কারা তাও জানেনা তারা।
জানা যায়, শিক্ষকদের প্রতিমাসের বেতন থেকে শতকরা ৬ভাগ অবসরভাতার জন্য এবং ৪ ভাগ কল্যাণ ফান্ডের জন্য রাখা হয়। তাদের সঞ্চিত টাকার সাথে সরকার কিছু অনুদান যুক্ত করে বেসরকারি শিক্ষকদেরকে কল্যাণ ফান্ডের এবং অবসরের ভাতা দিয়ে থাকেন। তাদের এই ভাতা পেতে বছরের পর বছর ভুগতে হয়। 
জমিয়াতুল মোদাররেসিন টাঙ্গাইল জেলা শাখা, অধ্যক্ষ পরিষদ, বাংলাদেশ শিক্ষক পরিষদ, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষক পরিষদ এব্যাপারে কোন তথ্য দিতে পারেননি। 
টাঙ্গাইল জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ও জানেনা জেলায় মোট কতজন অবসরে গেছেন যারা অবসর ভাতার জন্য ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কারণ হিসেবে তারা জানান, অবসর সংশ্লিষ্ট কোন কার্যক্রম আমাদের দপ্তরে হয়না।
জামিয়াতুল মোদাররেসিন টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা জাহিদুল ইসলাম বলেন, যেসকল শিক্ষক-কর্মচারি অবসরে যাচ্ছেন তাদেরকে অনেক কষ্টকরে দিনাতিপাত করতে হয়। যারা অস্বচ্ছল তাদের চোখেমুখে অন্ধকার দেখা ছাড়া কোন পথ নেই। অনেকে খেতে খামারে কাজ করতে বাধ্য হন। 
অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি বজলুর রশীদ খান চুন্নু বলেন, অবসরে যাওয়া বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অন্তহীন দূর্ভোগ পোহাতে হয়। সন্তানের পড়ালেখার খরচ, সংসারের খরচ, বয়সের কারণে রোগাবালাই লেগে থাকার ব্যয় বহন করতে নিদারুণ কষ্ট করতে হয়।
বাংলাদেশ শিক্ষক পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শামীম আল মামুন বলেন, বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরে গিয়ে কল্যাণ ফান্ডের টাকা আর অবসরের এককালীন ভাতা পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকেন। অনেককে অবসরভাতা পাওয়ার আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়। বেসরকারি শিক্ষকরা মাসে মাসে কোন পেনশন পাননা। তাই অবসরের ভাতাটাই সম্বল। সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের অবসরভাতা ছয় মাসের মধ্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে বেসরকারি শিক্ষকদের ভোগান্তি লাঘব হবে।
এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার মহাপরিচালক ও অবসর সুবিধা বোর্ডের সহসভাপতি ড. মোহাম্মদ আজাদ খান বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ভাতা ও কল্যাণ ফান্ডে হযবরল অবস্থা পেয়েছি। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কোন ক্রমতালিকা ছিলনা। যেমনে ইচ্ছা তেমনে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। শিক্ষকদের নিকট থেকে সংগৃহীত কল্যাণ ফান্ড ও অবসর ভাতার টাকা বেসরকারি ব্যাংকে রেখে দায়িত্বপ্রাপ্তরা সুবিধা গ্রহণ করেছে। কিন্তু শিক্ষকদের কল্যাণের বিষয়টা তারা ভাবেনি। আমরা প্রথমেই ফান্ডগুলো কালেকশন করে রাষ্ট্রয়ত্ব ব্যাংকে রাখার ব্যবস্থা করেছি। এখন বেসরকারি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মাসে মাসে টাকা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। অপরদিকে অবসর ভাতার জন্য সরকার ২ হাজার কোটি টাকা এবং কল্যাণ ফান্ডের জন্য ২শ কোটি টাকার তহবিল দিয়েছে। আমরা ওই টাকা ট্রেজারি বন্ড করেছি। ওই টাকার প্রাপ্ত লভ্যাংশ থেকে ক্রমতালিকা অনুসারে বেসরকারি শিক্ষকদের ভাতা পরিশোধ করবো। ২০১৮ সালের আগে অবসরপ্রাপ্তদের ভাতার আবেদন কাগজপত্র অনেকগুলোই পাওয়া যায়নি। সারাদেশের অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারিদের অনলাইন তালিকা ২০২৩ সাল পর্যন্ত হাল নাগাদ করেছি। তাদের টাকাগুলো দ্রুতই দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
আনোয়ার সাদাৎ ইমরান
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি