ঢাকা | 04 November 2025

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন পারমাণবিক শক্তিতে চীন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলছে

প্রগতির আলো ডেস্ক, .
নিউজ প্রকাশের তারিখ :Oct 25, 2025 ইং
ছবির ক্যাপশন: ছবির ক্যাপশন:
ad728

পারমাণবিক শক্তিতে চীন দ্রুত বিশ্বের শীর্ষ স্থান দখল করছে। দেশটিতে নির্মাণাধীন পারমাণবিক চুল্লি  বর্তমান বিশ্বের অন্যান্য সব দেশের সংখ্যার তা প্রায় সমান। ইতোমধ্যে সৌর প্যানেল ও বৈদ্যুতিক গাড়ি খাতে চীনের আধিপত্য সুপরিচিত। পারমাণবিক শক্তির ক্ষেত্রেও দেশটি এখন অভাবনীয় অগ্রগতিতে এগিয়ে চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই চীনের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম দেশ যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পরমাণু বিভাজন প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিল।

চীনের বেশির ভাগ পারমাণবিক চুল্লি মার্কিন ও ফরাসি নকশার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর মতো নির্মাণ বিলম্ব ও ব্যয়বৃদ্ধির সমস্যায় তারা ভোগেনি। ফলে দেশটি এখন পরবর্তী প্রজন্মের পারমাণবিক প্রযুক্তিতে এমন সাফল্য অর্জন করছে, যা পশ্চিমা দেশগুলো এখনো পায়নি। একই সঙ্গে চীন পারমাণবিক ফিউশন প্রযুক্তিতে বিপুল বিনিয়োগ করছে। যা একদিন সীমাহীন পরিচ্ছন্ন বিদ্যুতের জোগান দিতে পারে।বেইজিংয়ের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো বিশ্বের শীর্ষ পারমাণবিক বিদ্যুৎ সরবরাহকারী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া। যে মর্যাদা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো হাতেগোনা কিছু দেশের রয়েছে।পারমাণবিক শক্তিতে চীনারা খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানান মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কার্নেগি এন্ডোমেন্ট ফর পিসের সিনিয়র ফেলো মার্ক হিবস। যিনি চীনের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর একটি বই লিখেছেন। তিনি বলেন, ‘চীন বিশ্বকে দেখাতে চায়, তাদের কর্মসূচি অপ্রতিরোধ্য।’

ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় জ্বালানি যুদ্ধক্ষেত্র

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতা করছে। এজন্য পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন এখন ভূ-রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র তেল, গ্যাস ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির শীর্ষ সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে চীন সৌর প্যানেল, বায়ু টারবাইন ও ব্যাটারি উৎপাদনে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করেছে। চীন নবায়নযোগ্য শক্তিকে সামনে ট্রিলিয়নের ডলার বাজার হিসেবে দেখছে।জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পারমাণবিক শক্তি বিশ্বব্যাপী আগ্রহ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, পারমাণবিক চুল্লিগুলো কয়লা বা গ্যাসের মতো বায়মণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়ার জন্য দায়ী কার্বন নিঃসরণ করে না। একইসঙ্গে সৌর বা বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে যেসব অনিশ্চয়তা থাকে, সেটাও এতে নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা বনাম চীনের অগ্রগতি

ট্রাম্প প্রশাসন ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা চারগুণ বাড়াতে চায়। দেশটি নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তি বিকাশের মাধ্যমে পারমাণবিক চুল্লি বিদেশে রপ্তানি করতে চায়। মার্কিন কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, যদি চীন পারমাণবিক রপ্তানি বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে তার বৈশ্বিক প্রভাবও ব্যাপকভাবে বাড়বে। কারণ একটি রিঅ্যাক্টর নির্মাণ প্রকল্প দুটি দেশের মধ্যে বহু দশকব্যাপী অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে।তবে রিঅ্যাক্টর নির্মাণে চীনের একটি সুস্পষ্ট সুবিধা রয়েছে। দেশটি তুলনামূলক কম খরচে এবং দ্রুত রিঅ্যাক্টর নির্মাণ করতে শিখেছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে একটি রিঅ্যাক্টর নির্মাণে গড়ে ১১ বছর সময় লাগে, সেখানে চীন মাত্র ৫–৬ বছরেই কাজ শেষ করছে।বৈজ্ঞানিক জার্নাল ‘নেচার’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০-এর দশকে চীনে পারমাণবিক চুল্লির নির্মাণ ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসে। এরপর থেকে স্থিতিশীল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে, জর্জিয়ার ভোগটল পারমাণবিক কেন্দ্রের দুটি নতুন রিঅ্যাক্টর তৈরি করতে ১১ বছর লেগেছে। এতে ব্যয় হয়েছে ৩৫ বিলিয়ন ডলার।হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের গবেষক শাংওয়েই লিউ বলেন, ‘আমরা প্রথম যখন চীনের ব্যয় কমার প্রবণতা দেখি, তখন আমরাও বিস্মিত হয়েছিলাম।’ এখন প্রশ্ন উঠেছে- যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও গতি ফিরিয়ে আনতে পারবে? 

পারমাণবিক শক্তিতে চীন কীভাবে দক্ষ হয়ে উঠল

আধুনিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল নির্মাণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি। তবে পারমাণবিক চুল্লি তৈরিতে চীনের সাফল্যের পেছনে মূল কারণ হলো সরকার নিয়ন্ত্রিত একীভূত কৌশল। তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত পারমাণবিক সংস্থা সরকার সমর্থিত কম সুদের ঋণ পায়—যা প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। একই সঙ্গে সরকার বিদ্যুৎ গ্রিড কোম্পানিগুলোকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ ক্রয়ে বাধ্য করে, যা বিনিয়োগকে সুরক্ষা দেয়।চীনের পারমাণবিক কোম্পানিগুলো সীমিতসংখ্যক চুল্লি নকশা ব্যবহার করে। সবসময় সেই মডেলগুলোই নির্মাণ করে। এতে নির্মাণ প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞতা বাড়ে, সরবরাহ শৃঙ্খলা সহজ হয় এবং প্রকল্প দ্রুত এগোয়। সাংহাইয়ের কাছে বিশাল কারখানায় নিয়মিতভাবে রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল তৈরি হচ্ছে, যা দেশজুড়ে নতুন প্রকল্পে পাঠানো হয়। দক্ষ ওয়েল্ডার দল এক প্রকল্প শেষ করেই পরবর্তী প্রকল্পের সাইটে গিয়ে কাজ করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে স্থবিরতা

যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০–৮০ দশকে সুদের হার বৃদ্ধি, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কঠোর নিরাপত্তার বিধিবিধান এবং থ্রি মাইল আইল্যান্ড দুর্ঘটনার মতো ঘটনাগুলো পারমাণবিক খাতকে প্রায় বন্ধ করে দেয়। বেসরকারি খাত নতুন নকশায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে নির্মাণ ব্যয় ও জটিলতা বাড়ায়। এর ফলে অসংগতি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।২০০০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রজন্মের এপি-১০০০ রিঅ্যাক্টর প্রকল্প শুরু হলেও ব্যয়বৃদ্ধি ও বিলম্বে তা বিপর্যস্ত হয়। কিন্তু একই সময়ে চীনও এপি-১০০০ নির্মাণ করতে গিয়ে নানান সমস্যায় পড়ে। কিন্তু  চীনারা সমস্যাগুলোর বিশ্লেষণ করে এবং নকশা উন্নত করে নিজস্ব সিএপি-১০০০ সংস্করণ তৈরি করে—যার আরও নয়টি রিঅ্যাক্টর এখন নির্মাণাধীন এবং পাঁচ বছরের মধ্যেই কম ব্যয়ে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নিরাপত্তা ও অনুমোদন প্রক্রিয়া

চীনের নিরাপত্তা মান পশ্চিমা বিশ্বের সমতুল্য, তবে অনুমোদন প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো প্রকল্পে রাজ্য সরকারের একাধিক অনুমতি লাগতে পারে, যা মাস বা বছরজুড়ে বিলম্ব ঘটায়। চীনে সাধারণত অনুমোদনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নির্মাণ শুরু হয়।‘চীন বিশাল অবকাঠামো নির্মাণে অভ্যস্ত। বাধ, মহাসড়ক, উচ্চগতির রেল— এসব প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দক্ষতাই পারমাণবিক খাতে সাফল্যের মূল’, বলেন লানতাও গ্রুপের পরামর্শক ডেভিড ফিশম্যান। তবুও চীনের সামনে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ২০২১ সালে একটি প্ল্যান্টে ছোট একটি বিকিরণ লিকেজ হয়। দেশটি এখনো পারমাণবিক বর্জ্য সংরক্ষণের জায়গা নির্ধারণ করতে পারেনি। কিছু শহরে বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রের পরিকল্পনা নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। পাশাপাশি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রচুর পানিসম্পদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দেশটির অভ্যন্তরে পানি ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগের কারণে নতুন রিঅ্যাক্টর প্রকল্পে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা

যুক্তরাষ্ট্রে এখন রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলের মধ্যেই পারমাণবিক শক্তির পক্ষে মতবিরোধ কমেছে। তবে দেশটি সরকারি নয়; বরং বেসরকারি উদ্ভাবন নির্ভর পথ বেছে নিয়েছে। ডজনখানেক স্টার্টআপ ছোট আকারের চুল্লি নিয়ে কাজ করছে, যা প্রযুক্তি কোম্পানি যেমন- গুগল, অ্যামাজন ও ওপেনএআই’র ডেটা সেন্টারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।

যদিও এসব প্রকল্প অগ্রসর হচ্ছে, তবে বড় আকারের রিঅ্যাক্টর নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও ভারী যন্ত্রপাতি তৈরির সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র অনেকাংশে হারিয়ে ফেলেছে।অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি স্টাডিজের ফেলো ফিলিপ অ্যান্ড্রুজ স্পিড বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক চুল্লির নকশার সংখ্যা এতো বেশি যে, মনে হয় আমাদের নির্দিষ্ট কিছু নকশায় মনোযোগ দেওয়া উচিত।’  

বৈশ্বিক রপ্তানি প্রতিযোগিতা

চীনের পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচির লক্ষ্য কেবল অভ্যন্তরীণ নয়—বিশ্ববাজারও। পাকিস্তানে ছয়টি রিঅ্যাক্টর নির্মাণের পর দেশটি আরও অনেক দেশে রপ্তানির পরিকল্পনা করছে। একই সঙ্গে চীন ‘চতুর্থ প্রজন্মের’ গ্যাস কুলড রিঅ্যাক্টর তৈরি করেছে। যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি ভারী শিল্পে তাপ সরবরাহ করতে পারে। তারা থোরিয়াম চুল্লি ও ব্যবহৃত পারমাণবিক জ্বালানি পুনর্ব্যবহারের প্রযুক্তিতেও কাজ করছে। কারণ, দেশটিতে পর্যাপ্ত ইউরেনিয়াম মজুত নেই।সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরবর্তী প্রজন্মের রিঅ্যাক্টর স্থাপনে চীন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে অন্তত ১০–১৫ বছর এগিয়ে। এক্ষেত্রেও ইতিহাস যেন নিজেকে পুনরাবৃত্ত করছে— যেমন সৌর প্যানেল ও ব্যাটারি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু সেই শিল্পের নেতৃত্ব এখন চীনের হাতে।

‘আমরা হয়তো কিছু মিত্র দেশকে চীনা রিঅ্যাক্টর না কেনার অনুরোধ করতে পারব’, বলেন সেন্টার ফর ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রেসিডেন্ট পল স্যান্ডার্স। তিনি বলেন, ‘কিন্তু শক্তির তীব্র চাহিদাসম্পন্ন আরও অনেক দেশ থাকবে। তাই, যদি আমেরিকা প্রস্তুতি না থাকে, তাহলে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না।’



কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ