ঢাকা | 12 September 2025

সরকার হটানোর ‘এশিয়া কাপ’, সামনে জেন-জি পেছনে কী

প্রগতির আলো ডেস্ক, .
নিউজ প্রকাশের তারিখ :Sep 11, 2025 ইং
ছবির ক্যাপশন: ছবির ক্যাপশন:
ad728

‘একটি ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে’। নেপালে সরকার পতনের পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবরের মন্তব্যগুলোতে ঘুরছে এই বাক্যটি। গভীর সমুদ্র থেকে আসা ঝড়ো হাওয়া পাহাড়ে ধাক্কা লেগে আরও ওপরে উঠে বৃষ্টি নামায় (অরোগ্রাফিক লিফটিং)। বাতাসের গতি বেশি হলে মাঝ পথে তছনছ করে ভূখণ্ডের প্রতিবেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সরকারবিরোধী আন্দোলনও যেন এই ধরন মেনেই এগুচ্ছে।

সরকার হটানোর প্রথম ঝড়টা শুরু হয় দ্বীপ দেশ হিসেবে পরিচিত শ্রীলঙ্কায়। এরপর বাংলাদেশ, সবশেষ দেখা গেল হিমালয়ের পাদদেশের নেপালে। মাঝে ইন্দোনেশিয়ায়ও তীব্র আন্দোলন হয়েছে। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের কাছাকাছি সময়ে বড় পরিসরে বিক্ষোভ হয়েছে পাকিস্তানে। আর প্রতিবেশী মিয়ানমারে সরকার ও বিরোধীদের মাঝে সংঘাত চলছে গত কয়েক বছর ধরে। এশিয়ার দেশগুলোর এমন পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা উল্লেখ করছেন পট পরিবর্তনের ‘এশিয়া কাপ’ হিসেবে। সরকার হটানোর এসব আন্দোলনে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে তরুণরা। বিশেষ করে যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে (জেনারেশন জেড)। নানা সংকট ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এসব দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন সংগ্রাম করলেও শেষ পরিণতিতে সামনে এসেছে জেন-জি’রা। তাদের বিক্ষোভের একটি সাধারণ বৈশিষ্ঠ্যও এরই মধ্যে আলোচনায় এসেছে। সেটি হলো; জেন-জি রাজপথে নেমে আন্দোলন শুরুর অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন হয়। 

প্রশ্ন উঠছে, দেশে দেশে এই তরুণদের ক্ষোভ তৈরির পেছনে কী বা কারা কাজ করেছে। আন্দোলন, সংগ্রামে জেন-জিদেরই বা কেন সামনে আনা হচ্ছে।

সামনে জেন-জি
স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম জেন-জির দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য্য উপাদান। আগের প্রজন্মের ‘আই হেট পলিটিক্স’ বয়ানের বিপরীতে জেন-জি বলছে, ‘রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’। ১৯৮৫-৯৫ এর প্রজন্ম যেখানে কেবল রাজনৈতিক সচেতনতার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইতো, সেখানে জেন-জি গড়ে উঠছে ‘সহপাঠী নেটওয়ার্ক’, মিম ও ভাইরাল ভিডিওর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। তারা অনলাইনের অ্যাক্টিভিজমকে অফলাইনের আন্দোলনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছে।মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের কল্যাণে সারা বিশ্বের ঘটনা প্রবাহ জেন-জি’র কাছে অজানা নয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা বৈষম্য ও অন্যায়ের ক্ষেত্রগুলো দ্রুত শনাক্ত করতে পারে। আর তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে কথা বলে, আওয়াজ তোলে। জানান দেয়, তারা আর পুরনো বন্দোবস্তোকে পছন্দ করছে না।

সবশেষ উদাহরণ নেপালের তরুণদের কথাই বলা যাক। দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক নেতাই রাজতন্ত্রের মতো পুরনো কাঠামো হটানোর নেতৃত্বদানকারী ছিলেন। কিন্তু বেশ কিছু কারণে জেন-জি তাদেরও পছন্দ করেনি। নতুন সরকার গঠনের বেলায়ও বলছে, এমন কাঠামো গড়ে তোলা হোক যাতে পুরনোরা আর ফিরে আসতে না পারে।

জেন-জিরা একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে। সেটি হলো- ঐতিহাসিকভাবে মহান হওয়া স্বত্বেও কেউ যদি অবিচার বা বৈষম্যের কারণ হন; তাহলে তারা ওই মহান ব্যক্তিদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকতে রাজি না।

নেপালে জেন-জির আন্দোলনের প্রসঙ্গ নিয়ে গতকাল বুধবার সমকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ এর মতামত প্রকাশ হয়েছে। তাঁর মতে, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কারণে বিশ্বের কোনো কিছুই এখন অজানা থাকছে না। এটি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যা অর্থনৈতিক অবস্থা, নীতিনির্ধারকদের জীবনযাপন ও তাদের পারিবারিক সদস্যদের জীবনযাত্রা– কোনো কিছুই লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। দার্শনিক হেবারমাস ও দেরিদা এক আলাপে বলেছিলেন, মোবাইল ফোনই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবে। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের আন্দোলনে এ ধরনের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। নেপাল এর সর্বশেষ উদাহরণ। 

আলোচনায় ‘ডিপ-স্টেট’

বাংলাদেশ, নেপালের সরকার পতনের পর জেন-জির উত্থানের পাশাপাশি সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি ‘ডিপ-স্টেট’। ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমে সরকার পতন সংক্রান্ত খবরের মন্তব্য, আলোচনা ও জিজ্ঞাসার প্ল্যাটফর্ম রেডিট কিংবা কোরাতেও জানতে চাওয়া হচ্ছে ডিপ-স্টেটের ভূমিকা নিয়ে। এসব আলোচনায় কেউ কেউ এশিয়ার দেশগুলোতে সরকার পতনের পেছনে ‘ডিপ-স্টেট’কে দায়ী করছেন। আবার কেউ কেউ প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বিষয়টিও তুলে ধরছেন।

‘ডিপ-স্টেট’ হলো সরকারের অভ্যন্তরীণ গোপন নেটওয়ার্ক বা বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ সংক্রান্ত তত্ত্ব। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পর মার্কিন ডিপ-স্টেটের ভূমিকা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা উঠেছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও অন্যান্য ঘটনার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো হাত নেই। ফেব্রুয়ারিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর এক সাংবাদিক ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। জবাবে ট্রাম্পও যুক্তরাষ্ট্র বা মার্কিন ডিপ-স্টেটের ভূমিকার কথা নাকচ করে দেন। এখন নেপালের সরকার পতনের পরও ডিপ-স্টেটের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা উঠেছে।এ প্রসঙ্গেও ফেরা যাক ইমতিয়াজ আহমেদের মতামতে। তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, শাসক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যখন বিভাজন তৈরি হয়, তখন আন্তর্জাতিক মহল ঘটনা নিজেদের মতো ব্যবহার করতে চায়। নেপালের ঘটনাতেও ভারত ও চীনের দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততাও থাকতে পারে। এ নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা হতেই পারে। কিন্তু আমি মনে করি, ঘরের বিভাজনমূলক কাঠামোই প্রধান। অভ্যন্তরীণ বিভাজন আছে বলেই বহির্বিশ্বের উসকানি ও এর মাত্রা নিয়ে প্রশ্নগুলো আসে।’

পেছনে কী, ভবিষ্যত কোন দিকে
দিনের ঘটনাপ্রবাহর সারাংশ ইমেইলের মাধ্যমে পাঠকদের কাছে তুলে ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমস। বুধবার ‘নেপাল ইজ বার্নিং’ শিরোনামের ব্রিফিংয়ের একাংশে ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কেন অস্থির হয়ে উঠছে’ তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেখানে গণমাধ্যমটির ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার সংবাদদাতা আলেক্স ট্রাভেলি বলেন, এই প্রশ্নের উত্তর কেউই সঠিকভাবে জানে না। এই দেশগুলো অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে অবস্থানের দিক থেকে একে অপরের থেকে ভিন্ন। তবে তাদের মধ্যে যে মিল আছে তা হলো; তরুণদের মধ্যে তীব্র বেকারত্বের সমস্যা এবং প্রভাবশালী অভিজাত শ্রেণির দীর্ঘদিনের প্রভাব।

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের আন্দোলন ছিল দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সংকট, চাকরির বৈষম্য, গুম, মত প্রকাশে বাধা ও দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো ঘিরে। লঙ্কানরা নির্বাচনের মাধ্যমে বামপন্থী সরকার বেছে নিয়েছে। তবে দেশটির অর্থনৈতিক সংকট এখনো পুরোপুরি কাটেনি। বাংলাদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি সংস্কারে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা ও ‘মব সহিংসতা’ নিয়ে মানুষের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষ পর্যন্ত কোন দিকে গড়াবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। ঢাকা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সন্ধানে আছে। কলম্বো অর্থনীতি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। কাঠমান্ডু কোন পথে যাবে সেটি এখনো প্রক্রিয়াধীন।



কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ