ঢাকা | 12 September 2025

বাবুই পাখি অস্তিত্বের হুমকির মুখে

প্রভাষক মোহাম্মদ নাজিবুল বাশার, .
নিউজ প্রকাশের তারিখ :Aug 28, 2025 ইং
ছবির ক্যাপশন: ছবির ক্যাপশন:
ad728
বাবুই পাখি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও শিল্পীমনস্ক পাখি, যা তার নিপুণ বুনন দক্ষতার জন্য বিখ্যাত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার, বনভূমি ধ্বংস এবং প্রাকৃতিক আবাসস্থল হারানোর কারণে এই পাখির অস্তিত্বের হুমকির মুখে পড়েছে। কৃষিকাজে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যাপক প্রয়োগ বাবুই পাখির খাদ্য শৃঙ্খলকে ব্যাহত করছে। পোকামাকড় মারা যাওয়ায় তাদের খাদ্যের অভাব দেখা দিচ্ছে, আর কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় সরাসরি পাখিগুলো মারা যাচ্ছে। নগরায়ন, কৃষিজমি বিস্তার ও অবাধে গাছ কাটার ফলে বাবুই পাখির বাসস্থান-বিশেষ করে তাল, নারিকেল ও খেজুর গাছ—হারিয়ে যাচ্ছে। এরা সাধারণত উঁচু গাছে দলবদ্ধভাবে বাসা বানায়, কিন্তু গাছ কমে যাওয়ায় তাদের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবহাওয়ার অনিয়মিততা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাবুই পাখির বাসা বাঁধা ও ডিম ফোটার প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। প্লাস্টিক দূষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়াও বাবুই পাখির জন্য বিপদ ডেকে আনছে। বাবুই পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি বড় ক্ষতি। এদের শিল্পীসুলভ বাসা এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না। বাস্তুতন্ত্রে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, কারণ বাবুই পাখি কীটপতঙ্গ খেয়ে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখে। প্রাকৃতিক আবাস রক্ষার গাছ তাল, খেজুর ও নারিকেল গাছ রোপণ এবং বনভূমি সংরক্ষণ। রাসায়নিক কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে জৈব পদ্ধতি প্রয়োগ। জৈব কৃষি উৎসাহিত করতে হবে। স্থানীয় সম্প্রদায়কে বাবুই পাখি সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বাবুই পাখির সংরক্ষণে প্রকল্প হাতে নেওয়া এবং গবেষণা ও নীতিনির্ধারণ সৃষ্টি করা। বাবুই পাখি রক্ষায় আরো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে বাবুই পাখির অস্তিত্ব রক্ষায় শুধু বনভূমি সংরক্ষণ বা কীটনাশক নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয়। আরো কিছু গভীর ও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োকজন। স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মধ্যই বাবুই পাখির বাসা বাঁধার জন্য উপযুক্ত গাছ তাল, খেজুর, নারিকেল রোপণে স্থানীয় মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে বাবুই পাখি সম্পর্কে সচেতন করবে। গ্রামীণ এলাকায় বাবুই পাখির বাসা সংরক্ষণের জন্য কমিউনিটি ভিত্তিক প্রকল্প চালু করলে পরিবেশ ফিরে পেয়ে যাবে। বাবুই পাখিকে রক্ষায় আইনগত সুরক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজন। বাবুই পাখিকে "সুরক্ষিত প্রজাতি" হিসেবে ঘোষণা করে বাসা ধ্বংস বা শিকার বন্ধ করতে কঠোর আইন প্রণয়ন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে বাবুই পাখির আবাসস্থল ধ্বংসের বিরুদ্ধে জরিমানা ও শাস্তির ব্যবস্থা করা। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাবুই পাখির বংশবৃদ্ধি, অভিযোজন ও বাস্তুতন্ত্রে এর ভূমিকা নিয়ে গবেষণা চালানো। বিকল্প বাসস্থান তৈরি করে যেসব এলাকায় প্রাকৃতিক গাছ কমে গেছে, সেখানে কৃত্রিম বাবুই বাসা স্থাপন করা যেতে পারে। শহর ও গ্রামে গ্রিন করিডোর তৈরি করে বাবুই পাখির চলাচল ও বাসা বাঁধার সুযোগ বাড়ানো। একটি গণমাধ্যম ও সামাজিক আন্দোলনে বাবুই পাখি রক্ষায় ডকুমেন্টারি, সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন ও গণসচেতনতা মূলক কার্যক্রম চালানো। শিল্পী, সাহিত্যিক ও সেলিব্রিটিদের সম্পৃক্ত করে "বাবুই পাখি বাঁচাও" আন্দোলন গড়ে তোলা। জলবায়ু সহনশীল উদ্যোগে বাবুই পাখির বাসা সাধারণত তালগাছে বেশি দেখা যায়, কিন্তু জলবয়ু পরিবর্তনের কারণে তালগাছের সংখ্যা কমছে। তাই জলবায়ু সহনশীল গাছ রোপণে জোর দেওয়া প্রয়োজন। খরা ও বন্যার প্রভাব মোকাবিলায় বাবুই পাখির নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করলেই পরিবেশ ফিরে পাবে। পর্যটন ও ইকো-ট্যুরিজমের সুযোগে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে। ইকো-ট্যুরিজম এর মাধ্যমে বাবুই পাখির এলাকাগুলো সংরক্ষণ ও আর্থিকভাবে স্থানীয়দের সহায়তা করা সম্ভব। বাবুই পাখি উৎসব বা বার্ড ওয়াচিং ইভেন্টের আয়োজন করে মানুষকে প্রকৃতির সাথে যুক্ত করা। সময় এখনই! বাবুই পাখি শুধু একটি পাখি নয়, এটি বাংলার প্রকৃতি ও সংস্কৃতির অঙ্গ। এটি হারিয়ে গেলে শুধু একটি প্রজাতিই নয়, আমাদের পরিবেশের ভারসাম্যও বিঘ্নিত হবে। তাই সরকার, গবেষক, স্থানীয় সম্প্রদায় ও সাধারণ মানুষ-সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বাবুই পাখি রক্ষায় আরও গভীর ও সমন্বিত উদ্যোগ বাবুই পাখির বিলুপ্তির আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। শুধুপ্রাগত সংরক্ষণ প্রচেষ্টা নয়, এখন প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত সমন্বয়ে একটি সামগ্রিক কৌশল। আসুন বিস্তারিতভাবে কিছু অপরিহার্য পদক্ষেপ দেখি। ডিএনএ ব্যাংক ও জিনগত গবেষণায় এসেছে বাবুই পাখির জিনোম সিকোয়েন্সিং করে এর অভিযোজন ক্ষমতা ও রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা বোঝার চেষ্টা করা। ভবিষ্যতে কৃত্রিম প্রজননের জন্য ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ। স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং ও ডেটা অ্যানালিটিক্স কিছু বাবুই পাখির গায়ে ন্যানো-ট্যাগ লাগিয়ে তাদের অভিবাসন পথ, বাসা বানানোর অভ্যাস ও বেঁচে থাকার হার ট্র্যাক করা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে বাবুই পাখির আবাসস্থল ধ্বংসের সম্ভাব্য এলাকা চিহ্নিত করা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় ভারতে, মিয়ানমারে ও নেপালে বাবুই পাখির বিচরণ রয়েছে। ট্রান্সবাউন্ডারি সংরক্ষণ চুক্তি করে এই অঞ্চলে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া। আইইউসিএন-এর রেড লিস্টে বাবুই পাখির অবস্থান পুর্নমূল্যায়ন ও বৈশ্বিক তহবিল গঠন। বিকল্প খাদ্য উৎস তৈরির কীটনাশকের কারণে পোকামাকড় কমে যাওয়ায়, বাবুই পাখির জন্য প্রোটিন সমৃদ্ধ কৃত্রিম খাবার সরবরাহের পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালু করা। জৈব কীটনাশক ব্যবহার করে পোকামাকড়ের সংখ্যা বাড়ানো, যাতে বাবুই পাখির খাদ্য শৃঙ্খল ঠিক থাকে। বাবুই পাখিকে 'সাংস্কৃতিক প্রতীক' হিসেবে প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের জাতীয় পাখি বা 'প্রকৃতির স্থপতি' হিসাবে বাবুই পাখিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ। ডাকটিকিট, স্মারক মুদ্রা বা স্থানীয় শিল্পকর্মে বাবুই পাখির ছবি ব্যবহার করে সচেতনতা বাড়ানো। ক্লাউড-সোর্সড ডেটা কালেকশনে একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা, যেখানে সাধারণ মানুষ বাবুই পাখির বাসার ছবি ও অবস্থান আপলোড করতে পারবে। এই ডেটা বিশ্লেষণ করে রিয়েল-টাইম হটস্পট ম্যাপ তৈরি করা, যেখানে সংরক্ষণ কাজ জোরদার করা প্রয়োজন। জলাভূমি পুনরুদ্ধারে বাবুই পাখি শুধু গাছেই নয়, নদী-পাড়ের ঝোপঝাড় ও জলাভূমিতেও বাসা বাঁধে। হাওর ও নদীর পাড়ে গাছ রোপণ করে এই বাসস্থান ফিরিয়ে আনা। বাবুই পাখি-বান্ধব নগর পরিকল্পনা নতুন রাস্তা বা বাড়ি তৈরির সময় বাবুই করিডোর রাখা উঁচু গাছ, খোলা জায়গা। সিটি কর্পোরেশনকে বাবুই পাখির বাসার জন্য নগর উদ্যানে বিশেষ জোন তৈরির নির্দেশ দেওয়া। জাদুঘর ও লাইভ স্ট্রিমিং প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরে বাবুই পাখির বাসা ও জীবনচক্রের ইন্টারেক্টিভ প্রদর্শনী করা। বাবুই পাখির বাসা বাঁধার ভিডিও লাইভ স্ট্রিম করে মানুষকে প্রকৃতির এই অদ্ভুত শিল্পীকে দেখার সুযোগ দেওয়া। ভবিষ্যতের জন্য জরুরি পদক্ষেপ "বাবুই পাখি টাস্কফোর্স" গঠন করে সরকার, বিজ্ঞানী ও এনজিওদের সমন্বয় বাড়ানো। প্রতি বছর "জাতীয় বাবুই পাখি দিবস" পালন করে গণজাগরণ সৃষ্টি করা। চূড়ান্ত বার্তা এই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাবুই পাখি শুধু একটি পাখি নয়-এটি আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য, বাস্তুতন্ত্রের স্থপতি এবং বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। যদি আজ আমরা পদক্ষেপ না নেই, আগামী প্রজন্ম শুধু কবিতা আর ছবিতেই এই শিল্পী পাখিটিকে দেখবে। "প্রকৃতি কথা বলে বাবুই পাখির বাসার নকশায়, আমাদের দায়িত্ব তা রক্ষার-এখনই সময়!" এখনই স্থানীয়ভাবে গাছ লাগানো, কীটনাশক কম ব্যবহার ও সচেতনতা ছড়িয়ে  দেওয়ার মাধ্যমে শুরু করুন। বাবুই পাখি রক্ষায় আপনার একটি ছোট পদক্ষেপই বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে! দেশ ও জাতীর।

লেখক: প্রভাষক মোহাম্মদ নাজিবুল বাশার, ভাইঘাট আইডিয়াল ডিগ্রি কলেজ, ধনবাড়ী, টাঙ্গাইল।




কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ